ফটিকছড়ি প্রতিনিধি: রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর দিচ্ছে আশার হাতছানি। প্রস্তুত দুই পাড়ে স্থল বন্দরের সকল স্থাপনা। খুব শিঘ্রই উদ্ভোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এটি হবে বাংলাদেশের ১৫তম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম স্থলবন্দর। বিকশিত হবে পন্য আমদানী-রপ্তানী ও পর্যটন শিল্পের। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে সরকার রামগড়-সাব্রুম সীমান্তে এ স্থলবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে দু-দেশের সরকার। ভারত স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আদিত্য মিত্র ও কাস্টমসের প্রধান কমিশনার যোগেন্দ্র র্গাগসহ উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল বুধবার রামগড় ও সাব্রুম স্থলবন্দর চেক স্টেশন পরিদর্শন করে এমন আশার কথা জানান। পরিদর্শনকালে ভারতীয় ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে ছিলেন, ভারত স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষর পরিচালক (প্রকল্প) গীতেশ দীপ, ভারতের কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার টমাস বাসু মিত্র, সহকারী কমিশনার অভ্যুদয় গুহ, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সহাকারী প্রকৌশলী কাভার সিং, ম্যানেজার ডি নন্দী, চট্রগ্রামে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাই কমিশনার এইচ ই ড. রাজীব রঞ্জন, বাংলাদেশের রামগড় ৪৩ বিজিবি’র পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান ও সাব্রুমের ৯৬ বিএসএফ’র কমান্ড্যান্ট কৃষ্ণ কুমার লাল উপস্থিত ছিলেন। রামগড়-সাবরুম স্থলবন্দর চালুর লক্ষ্যে খাগড়াছড়ির রামগড়ে মহামুনি এলাকায় ফেনী নদীর ওপর ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৪ দশমিক ৮০ মিটার প্রস্থ মৈত্রী সেতু-১ নামে একটি আন্তর্জাতিক সেতু নির্মাণ করা হয়। এতে খরচ হয়েছে ১৩৩ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের নাজিরহাট হতে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১১২ কিলোমিটার দূরত্বের এই স্থলবন্দর ব্যবহার করে মাত্র তিন ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য ভারতের ত্রিপুরার সাব্রুমে পৌঁছানো যাবে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাজ্যের মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, আসাম, ও অরুণাচলের তথা সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হবে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে পরিবহন সংযোগের উন্নতির ফলে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি ১৭২ শতাংশ এবং ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ২৯৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। বন্দরটি চালু হলে পরিবর্তন হবে উত্তর চট্টগ্রাম ও পাহাড়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থার। রামগড় স্থলবন্দরের প্রকল্প পরিচালক মো. সরোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন র্কাযক্রম চালুর প্রস্তুতি দেখার জন্য ভারতীয় প্রতিনিধি দলটি সরেজমিনে পরিদর্শনে এসেছেন। ইমিগ্রেশন কার্যক্রম চালু করার জন্য রামগড় ইমিগ্রেশন ভবন পুরোপুরি প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী ইমিগ্রেশন কার্যক্রমের উদ্বোধন, উদ্বোধনের দিন ও তারিখ ঠিক করবেন। জানা গেছে, ২০২১ সালের ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে খাগড়াছড়ির রামগড়ে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত বাংলাদেশ-ভারত প্রথম মৈত্রী সেতু-১ উদ্বোধন করেন। ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর ভারত ও বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে বাংলাদেশের দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা ব্যবহার করার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় রামগড় বন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের বিষয়টিও ছিল। বন্দরটি চালু হলে উত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। তার আগে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরকালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সঙ্গে বৈঠকে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দর চালুর যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়, রামগড় স্থলবন্দর চালুর লক্ষ্যে রামগড়ের মহামুনি এলাকায় অধিগ্রহণকৃত ১০ একর জায়গায় বন্দরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর মধ্যে আইসিপি, কাস্টমস, প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন, পোর্ট বিল্ডিং, ট্রান্সশিপমেন্ট শেড, ওয়্যার হাউজ, ইয়ার্ডসহ বিভিন্ন অফিস ও আবাসিক ভবন ইত্যাদি নির্মাণের জন্য ১২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয় স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মনিকো লিমিটেড নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রসঙ্গত: বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ইমিগ্রেশন চেক পোস্টের মাধ্যমে রামগড়- সাব্রুম সীমান্ত পথে দু'দেশের শত-শত নাগরিক গমনাগমন করতো। ১৯৮৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে এ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রামগড় স্থলবন্দর চালু হলে বাংলাদেশ থেকে প্রসাধন সামগ্রী, সিরামিক ও মেলামাইল পণ্য, সিমেন্ট, ইট, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, তামাক জাতীয় পণ্য, শুঁটকি প্রভৃতি ত্রিপুরা রাজ্যে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। অন্য দিকে ত্রিপুরা থেকে কাঠ, বাঁশ, পাথর, মসলা প্রভৃতি পণ্য আমদানি করা যাবে। প্রসার ঘটবে পর্যটনশিল্পের। সীমান্তর ওপারের কবি-শিক্ষক অশোকানন্দ রায় র্বধন জানান, মৈত্রী সেতু, স্ধলবন্দরেরর সাথে সমানতালে সেখানকার অভ্যন্তরীণ মহাসড়কের উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। গত অক্টোবরে সাব্রুম থেকে আগরতলা রেল সার্ভিস চালু করা হয়েছে। সাব্রুমে স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তুলতে বিপুল পরিমাণ জমিও অধিগ্রহণ করেছে। এই অঞ্চলে দুই পাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের মেল বন্ধন রয়েছে। এই স্থলবন্দর হলে র্দীঘদিন পর নতুন করে এদিকে রামগড়-সাব্রুম স্থলবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ সড়ক হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বারৈয়ারহাট হতে রামগড় পর্যন্ত সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। বর্তমানে এ সড়কে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬টি ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণের কাজ করছে জাইকা। চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সৌম্য তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, রামগড়-বারইয়ারহাট সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ৩৮ কিলোমিটার সড়কটি ৫ দশমিক ৫ মিটার থেকে ৭ দশমিক ৩ মিটার প্রশস্ত করা হবে। ভূমি অধিগ্রহণসহ কাজ চালু আছে। সড়কটি উভয় দেশের যোগাযোগ খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, 'রামগড় স্থল বন্দরকে কেন্দ্র করে পুরো চট্টগ্রামের দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। বন্দরকে কেন্দ্র করে সড়ক সংস্কার হতে শুরে করে একাধিক বড় সেতু ও সড়ক নির্মাণ হচ্ছে। রামগড়ের এ বন্দরে স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রার মান অভাবনীয় পরিবর্তন হবে। বিজিএমইএর সহ-সভাপতি ও ফটিকছড়ির বাসিন্দা রাকিবুল আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, 'এ বন্দরের সরচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো। তারা সহজে ও কম খরচে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুবিধা দেবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি ব্যবসায়িরাও রপ্তানির একটি নতুন দ্বার পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সহজে ভারত থেকে পশুসম্পদ, ফল, কাঠ, বীজ, গম, পাথর, কয়লা, সার ইত্যাদি আমদানি করতে পারবে। সর্বোপরি এ বন্দর উত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বয়ে আনবে; বিকশিত হবে পাহাড়ের পর্যটন শিল্প। খাগড়াছড়ির স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শরণার্থী পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা সাংবাদিকদের বলেন, 'ভারতের সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের শত বছরের সম্পর্ক। বৈধ কোনো রুট না থাকায় মানুষ অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার করতো। এখন বৈধ উপায় তৈরী হলে মানুষের দুর্ঘব লাঘব হবে। পাশাপাশি রামগড় স্থল বন্দরকে ঘিরে ইতোমধ্যে খাগড়াছড়িতে জমির দাম কয়েকগুন বেড়ে গেছে। এছাড়া পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। স্থল বন্দরটি চালু হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি দুই দেশের বাণিজ্যিক, পর্যটন ও যোগাযোগ সর্ম্পক সুদৃঢ় হবে।