আমার সাম্প্রতিক প্রবন্ধ ‘সমাজবিজ্ঞানী বিদ্যাসাগর’ (৪-৬) প্রসঙ্গে যে প্রতিক্রিয়া পাঠকদের কাছ থেকে পেয়েছি, তাতে আমি অভিভূত। সম্পাদকের দফতরে পাঠানো চিঠিগুলি শুধু যে বর্তমান কালেও বিদ্যাসাগরের বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা নির্দেশ করে, তা-ই নয়, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবন এবং কর্মের আলোচনা বিষয়ে আমাদের সমাজের চলমান আগ্রহের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৮৭১ সালে লেখা বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ-সংক্রান্ত প্রথম বইটিতে কুলীন বহুগামিতা বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমার সংক্ষিপ্ত রচনাটি প্রকাশের সময় ঠিক এমন প্রতিক্রিয়াই আমি আশা করেছিলাম। প্রবন্ধটির সংক্ষিপ্ত রূপের কারণে ওই কাজটির উপর আমার বক্তব্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক ছেঁটে দেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। আর তাই পাঠকদের আমি জানাতে চাই যে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বহুবিবাহ-র উপর আমার অনুবাদ বই আকারে প্রকাশিত হতে চলেছে, এগেনস্ট হাই-কাস্ট পলিগ্যামি শিরোনামে। এখানে ‘সমাজবিজ্ঞানী বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে যে বিষয়গুলি কিছুটা ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা আরও বিশদে বর্ণনা করা হয়েছে। ওই বইয়ের ভূমিকায় আমি বহুবিবাহ-কে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছি, এবং বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে, বিদ্যাসাগরের গবেষণা-আগ্রহের বিষয়টি বোঝার জন্যই বহুবিবাহ-র প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। এই বইয়ে আমরা এমন এক গবেষককে পাই যিনি নতুন পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করেন, এবং সেই তথ্যের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেন। একই সঙ্গে তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি এও বুঝতে পারেন যে, লেখক হিসেবে তিনি কৃতবিদ্য, সুতরাং কুলীনপ্রথার অমানবিক বাস্তবকে তিনি পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে পারবেন। দ্বিতীয় বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা দরকার। কেননা দেখছি, অন্তত এক জন পাঠকের কাছে আমার লেখা একটু ভুল ভাবে পৌঁছেছে। তিনি মনে করেছেন যে, বিদ্যাসাগরের ‘সমাজতত্ত্ব-কল্পনা’র কথা যখন আমি বলছি, আমি বোধ হয় কুলীন পরিবারে বিবাহিত মেয়েদের যন্ত্রণা এবং বঞ্চনাকে বাস্তবের চেয়ে কিছুটা লঘু করে দেখাতে চাইছি। সেটা কিন্তু কখনওই আমার বক্তব্য নয়। আমি বরং বলতে চাই যে, বিদ্যাসাগর যে ভাবে কৌলীন্য প্রথার কবলে অল্পবয়সি কন্যা এবং বধূদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাগুলিকে তুলে ধরছিলেন, তার জন্যই বহুবিবাহ আজও এমন প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ হয়ে রয়ে গিয়েছে। সমাজবিদ্যার প্রতি তাঁর কল্পনাসমৃদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি, তিনি যে কাহিনিগুলোর কথা বলেছিলেন সেগুলি প্রামাণ্য বা কোনও ব্যক্তিবিশেষের অভিজ্ঞতা কি না— তার চেয়েও অনেক বড় হয়ে উঠেছিল সাহিত্যধর্মী বর্ণনায় তাঁর অসামান্য পারদর্শিতা— এবং সমগ্র বাংলায় গ্রাম্যজীবন ও পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর নিজের বিপুল অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে— কৌলীন্য প্রথায় প্রোথিত অত্যাচারকে তুলে ধরায় তাঁর অতুলনীয় প্রয়াস। তাঁর প্রদত্ত পরিসংখ্যান এবং ঐতিহাসিক বিশ্লেষণগুলি যখন একত্র করে আমরা দেখি, বুঝতে পারি, তাঁর কজের গুরুত্ব কেবল সমাজসংস্কারে আবদ্ধ নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি। সমাজবিদ্যা, পরিসংখ্যানবিদ্যা, ইতিহাস, এই বিষয়গুলিকে এক তলে এনে কী ভাবে সমাজ বিশ্লেষণের কাজ করতে হয়, তাও আমরা শিখতে পারি। আশা করি, আমার নতুন বইটি পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের, এবং বৃহত্তর বৃত্তের পাঠকদেরও, আরও ভাল ভাবে বিদ্যাসাগরের এই পথপ্রদর্শনকারী সমাজচর্চার মূল্য ভাল করে বুঝতে সাহায্য করবে। ব্রায়ান হ্যাচার, টাফটস ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা